বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৭ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
টেকনাফ ছাড়াও এবার নতুন করে উখিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ভেসে আসছে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ চকরিয়ায় জেলা পরিষদের জমিতে নির্মিত আওয়ামী লীগের অফিস উচ্ছেদ সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও জাহাজ ছাড়ার পয়েন্ট নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটি গঠণ সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে কক্সবাজার শহরে এসে সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসির সড়ক অবরোধ পাহাড়ী আস্তানা থেকে মালয়েশিয়া পাচারকালে শিশুসহ ৩১ জন উদ্ধার, দুই দালাল আটক সাবের মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর পিএস ফিরোজ কক্সবাজারে গ্রেপ্তার মিয়ানমারের বাঘগুনা খালের পাশে রয়েছে নিমার্ণ সামগ্রী ও দুইটি ট্রলার, মাঝি-মাল্লা সহ ১১ জনের হদিস নেই মিয়ানমারের উপজাতি সম্প্রদায়ের ৬৫ নাগরিকের অনুপ্রবেশ চকরিয়ায় কিশোরকে ছুরিকাঘাত : আটক ৪ চকরিয়ায় ফেরিওয়ালার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

মিয়ানমারের ইতিহাসে প্রথম বার রোহিঙ্গাদের সমাদর বেড়েছে

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, এডভোকেট

মিয়ানমারে চরম অজনপ্রিয় গণবিরোধী সামরিক জান্তা সরকার মাত্র ১৭ভাগ ভুমির দখল নিয়ে এখনও ক্ষমতায় বহাল আছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত অং চান সুচীর দলসহ অন্যান্য দলের জাতীয় ঐক্য সরকার পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। তাদের অধীনের পিপলস ডিফেন্স ফোর্স নামের সেনাবাহিনী আছে। তারাও আরাকান আর্মির ও থ্রি ব্রাদারহুড এলাইয়েন্সের মত অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। বিদ্রোহীরা জান্তা সেনাদের পরাজিত করে বিভিন্ন শহর,সেনাচৌকি,সেনাস্থাপনা ইত্যাদি দখল করে নিচ্ছে। রাখাইন বা আরাকান রাজ্যও আরাকান আর্মি প্রায় দখল করে নিয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। তারপরও বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ বিমান, বোমাসহ মারাত্মক মরণাস্ত্র জান্তা বাহিনীর হাতে আছে বিধায় হরানো ভুমি পুনদখল করার জন্য মরণকামড় দেবে তা স্বাভাবিক। বিদ্রোহীদের হাতে মারা যাওয়ায়,আত্মসমর্পণ করায় ও পালিয়ে যাওয়ায় মিয়ানমারের সরকারী জান্তা বাহিনীর সেনা সদস্যের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। মিয়ানমারের যুব সমাজ নতুনভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করার জান্তা সরকারের আহŸানে সাড়া না দিয়ে দেশ ত্যাগের চেষ্টা করছে। তাই সেনাবাহিনীতে আবশ্যিকভাবে যোগদান করার আইন আবার কার্যকরী করেছে জান্তা সরকার। বাংলাদেশে প্রায় ১৪লাখ আশ্রিত রোহিঙ্গা আছে,বিশ্বের অন্যান্য দেশেও প্রায় ৩লাখ রোহিঙ্গা আছে এবং মিয়ানমারে এখন প্রায় ৪লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুৎ হয়ে আশ্রয় শিবিরগুলোতে বা স্বগ্রামে বসবাস করছে বলে জানা যায়। সেখান থেকে প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গা যুবককে জান্তা বাহিনী সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করার জন্য ধরে নিয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব,সেনাবাহিনীতে চাকুরী ও লাখ টাকা বেতন দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হচ্ছে। আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে বিদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনের আশ্বাস দিয়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে সক্রিয় সহযোগিতা চেয়েছেন। জাতীয় ঐক্য সরকারের একজন মন্ত্রীও বাংলাদেশ সফর করে রোহিঙ্গাদের তাদের বৈধ নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নাগরিকত্ব দিয়ে মিয়ানমারে সম্মানের সাথে প্রত্যাবাসনের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। পত্রপত্রিকায় ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে উল্লেখিত বিষয়গুলি দেখে,শুনে ও পড়ে মনে হচ্ছে আগের বার্মা, এখন মিয়ানমারের ইতিহাসে প্রথমবারের মত রোহিঙ্গাদের নিজেদের বৈধ নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে চলমান গৃহযুদ্ধে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা কামনা করে স্বদেশে সসম্মানে ফিরিয়ে নেওয়ার অঙ্গিকার ঘোষণা করছে জান্তা সরকার, আরাকান আর্মি ও জাতীয় ঐক্য সরকার। চিরনির্যাতিত,সদাপ্রবঞ্চিত, বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের গুরুত্ব,চাহিদা ও সমাদর এখন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চোরাচালান নিরুৎসাহিত করতে ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্য চালু করা হয় যা এখনও বহাল আছে। মিয়ানমার থেকে আমদানী হয়ে আসে হিমায়িত রুই,কাতলা,ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ, আচার, শুটকি, সুপারী, নারিকেল, পেঁয়াজ, ছোলা, আদা, চাল, শুকনা মরিচ,তরমুজ,পাকা ও কাচা আম,হলুদের মত পণ্য। আর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানী হয় আলু,প্লাস্টিকসামগ্রী,গার্মেন্ট কাপড়,গেঞ্জি,কোমল পানীয়,চুল,চিপস,চনাচুর, বিস্কুট, টিউবওয়েল, সিমেন্ট ও বিভিন্ন ধরনের ঔষুধ । এতে করে টেকনাফ স্থলবন্দরে বাংলাদেশের দৈনিক তিন কোটি টাকার বেশী রাজস্ব আয় হয় বলে জানা যায়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জেলা শহর মংডুর আশেপাশের কয়েকটি এলাকায় টানা আট দিন ধরে রাতদিন থেমে থেমে গ্রেনেড,বোমা ও মর্টারশেল বিস্ফোরণের শব্দে এই পারের গ্রামগুলোও কেপে উঠছে। এতে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিথুয়ের(আকিয়াব) সাথে বুচিডং-রাচিডং হয়ে মংডু টাউনশিপের মধ্যে শত কিলোমিটারের সড়ক ও নৌপথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ফলে সিথুয়ের সাথে বাংলাদেশের টেকনাফের স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানী সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পড়েছে। অবশ্য চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী রাখাইন রাজ্যে অবৈধভাবে রপ্তানী হয়ে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশ দৈনিক কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রমজান মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার ও সহজ প্রাপ্যতার অভাব সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

আরাকান আর্মি রাখাইন বা আরাকান রাজ্যের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে মর্মে ঘোষণা করে নাই। অন্যান্য যুদ্ধরত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও স্বাধীনতা চায় না । তারা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনসহ কনফেডারেশন ধরনের কেন্দ্রীয় সরকার চায়। কেন্দ্রে সামরিক বাহিনী সমর্থিত জান্তা সরকার থাকুক বা জাতীয় ঐক্য সরকার আসুক আমাদের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মিকে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য,শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের জন্য এবং বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের জন্য আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ ও সুস্পর্ক স্থাপন করা দরকার। চীন সরকার জান্তা সরকারকে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আবার আরাকান আর্মি সহ অন্যান্য যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলোকেও অস্ত্রসহ অন্যান্যভাবে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে আসছে চীন তাদের নিজদের স্থাপনাগুলিকে নিরাপদ রাখার স্বার্থে। আমাদেরকেও জাতীয় স্বার্থে চীনের মত একই ধরনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নীতি অনুসরণ করতে হবে।

বহুল প্রচার আছে যে রোহিঙ্গা নেতারা ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে আরাকানের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলো নিয়ে তারা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যোগদান করার জন্য জিন্নাহ সাহেবের সাথে দেখা করেছিলেন। সেই কারণে তখন থেকে রোহিঙ্গাদের বার্মিজ সেনাবাহিনী ও রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা অবিশ্বাস করতো ও নির্যাতন করতো। এই বার রোহিঙ্গাদের অনেকগুলি গ্রæপ আছে। আরশা জান্তা বাহিনীর ডাকে সাড়া দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারে। আরএসও তাদের বাহিনী নিয়ে জাতীয় ঐক্য সরকারে যোগ দিতে পারে। রোহিঙ্গা অন্যান্য গ্রæপগুলো আরাকান আর্মির সাথে যোগ দিতে পারে। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে যে বা যারা চুড়ান্তভাবে জয়ী হউক না কেন রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে তখন বিবেচনা থেকে বাদ দিতে পারবে না। সকলে বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে আমেরিকা বা ইহুদী বা অন্য ধর্মের লোকদের সাহায্য,দান, খয়রাত খেয়ে নিরাপদে অবস্থান করার নীতি গ্রহন করলে শেষে ’আমও যাবে ছালাও যাবে’। এখন রোহিঙ্গারা কোন যুদ্ধরত গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তু নয়। সুতরাং জাতিসংঘ কখন নিরাপদে সসম্মানে প্রত্যাবাসন করবে তার জন্য অপেক্ষা না করে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আরাকানের নিজেদের গ্রামে ফিরে গিয়ে পুনরায় বসবাস,চাষাবাদ শুরু করার এখন উত্তম সময়। রোহিঙ্গাদের বৈধ অধিকার আদায়ের জন্য তাদের মাতৃভুমিতে উপস্থিত থাকতে হবে। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে যুবকরা গোপনে যুদ্ধে গেলেও সাধারণ রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যেতে কোন বাঁধাও নাই। এখন জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে পরস্পরকে টার্গেট করে গোলাগুলি নিক্ষেপ করছে, রোহিঙ্গারা তাদের টার্গেট নয়। মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে তাদের স্বগ্রামে অবস্থান করা ছাড়া রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার সহ কোন অধিকার ফেরত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। প্রবাদ আছে, যে শিশু কান্না করে না সে শিশু মায়ের দুধও পায় না। সময় ও সুযোগ কারও জন্য অপেক্ষা করে না।

লেখক : একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা, সাবেক পিপি ও সাবেক সভাপতি, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888